জীবনের প্রতি প্রসন্নতা, পরিহাস ও বেদনা, ব্যঙ্গ ও করুণার এমন সন্নিবেশ আমরা আর কোনো বাঙালি নাট্যকারের মধ্যে পাইনি। ম্যাথু আরনল্ড, কিটসের কবিদৃষ্টি .....
দীনবন্ধু মিত্র
ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে 'নীলদর্পণ'-এর সার্থকতা এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটককে কেন দলিল বলা যায়
জীবনের প্রতি প্রসন্নতা, পরিহাস ও বেদনা, ব্যঙ্গ ও করুণার এমন সন্নিবেশ আমরা আর কোনো বাঙালি নাট্যকারের মধ্যে পাইনি। ম্যাথু আরনল্ড, কিটসের কবিদৃষ্টি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'He is with Shakespeare' সেই কথার প্রতিধ্বনি দীনবন্ধু সম্বন্ধেও বলা যায়।দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম : ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ও ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ দীনবন্ধু মিত্র পাড়ো লোক গামোণ করেন । ডাক বিভাগে কাজ করতেন দীনবন্ধু মিত্র। তার প্রথম ও সর্বাধিক পরিচিত নাটক : 'নীলদর্পণ' যেটি প্রকাশিত হয় (১৮৬০) সালে।'নীলদর্পণ' নাটকের বিষয় ছিল বাঙালি কৃষক ও ভদ্রলোকের প্রতি নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা। ‘নীলদর্পণ' নাটক টি তিনি আবের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন এবং তার নাম দিয়ে ছিলেন-The Indigo Planting Mirror |.লং সাহেব 'নীলদর্পণ' নাটকের প্রকাশক ছিলেন ।
ঈশ্বর গুপ্তের ভাবশিষ্য ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র ।দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনধর্মী নাট্যফসল 'লীলাবতী' (১৮৬৭) সমসাময়িক নাগরিক জীবনের হাস্য পরিহাস ও নায়ক-নায়িকার মিলন-সংক্রান্ত একটি জটিল কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে।মার্কিনি মহিলা ঔপন্যাসিক স্টো প্রণীত 'Uncle Tom's Cabin' (১৮৫২)-র সঙ্গে 'নীলদর্পণ' নাটকটিকে তুলনা করা হয় ।
'সধবার একাদশী (১৮৬৬) দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রহসনধর্মী নাটক। বিয়ে পাগলা বুড়ো' (১৮৬৬), 'লীলাবতী' (১৮৬৭), 'জামাই বারিক' (১৮৭২) প্রভৃতি দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন ও প্রহসনধর্মী অন্যান্য নাটক , 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' ও 'পোড়ামহেশ্বর' নাট্যকার দীনবন্ধুর দুটি গদ্য।গোলকচন্দ্ৰ, নবীনমাধব, সাধুচরণ, সাবিত্রী, সরলতা, তোরাপ, ক্ষেত্রমণি, আদুরী, পদীময়রাণী,নীলদর্পণ' নাটকের চরিত্র ।
দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রহসন 'সধবার একাদশী' (১৮৬৬) শ্রেষ্ঠ প্রহসন। এই নাটকের নায়ক নিমে দত্ত চরিত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের প্রতিচ্ছায়া আছে, কিন্তু তাকে টাইপ চরিত্র বলা যাবে না। বরং বলা যায়, শিক্ষাদীক্ষায় মার্জিত, জীবনের শুভাশুভ বিষয়ে প্রখর চেতনাসম্পন্ন একটি মানুষ ।এই চরিত্রটির জন্যেই সধবার একাদশী প্রহসনের সীমা অতিক্রম করে গভীর রসাত্মক নাটকে পরিণত হয়েছে।
ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে 'নীলদর্পণ'-এর সার্থকতা :-
'নীলদর্পণ' নাটক ট্র্যাজেডি হিসেবে খুব সার্থক হয়নি। এতে তিনি জনসাধারণ ও দুষ্টু চরিত্রাঙ্কনে অসাধারণ বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিলেও তথাকথিত সৎ ও সাধু প্রকৃতির ভদ্র চরিত্র অঙ্কনে ততটা সার্থক হননি। এদের ব্যবহার, ভাষা ইত্যাদি অত্যন্ত কৃত্রিম হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ট্র্যাজেডির সূক্ষ্মতা,বেদনার তীব্রতা প্রভৃতির চেয়ে খুনোখুনি, আত্মহত্যা প্রভৃতি স্প্যানিশ ট্র্যাজেডির মতো রক্তারক্তির বাহ্যিক আড়ম্বরটাই এ নাটকে প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।
কমেডি নাটক রচয়িতা হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের প্রতিভার পরিচয় :-
দীনবন্ধুর প্রতিভা মূলত শ্রেষ্ঠ কমেডি লেখকের প্রতিভা। উচ্চশ্রেণির নাট্যধর্মময় কৌতুক ও পরিহাস, জীবনের ক্ষয়ক্ষতির প্রতি নিঃস্পৃহতা, নানা অসংগতির প্রতি প্রথমশ্রেণির হাস্যরসিকের মতো সকৌতুক সহনশীলতা-এর দ্বারা তিনি বাংলা নাটকে স্পৃহনীয় স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দীনবন্ধু মিত্রের রচিত দুটি কমেডি নাটকের নাম : 'নবীন তপস্বিনী' (১৮৬০) ও কমলে কামিনী' (১৮৭৩)।
'বিয়ে পাগলা বুড়ো' ও 'জামাইবারিক' কী ধরনের নাটক ? নাটক দুটির মূলভাব কী ?
প্রহসনধর্মী নাটক। "বিয়ে পাগল বুড়ো' (১৮৬৬) প্রহসনে বিবাহবাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের অকালপরিপক্ক ছেলেরা কীভাবে তাকে নাস্তানাবুদ করেছিল তারই এক কৌতুককর কাহিনি বর্ণিত। 'জামাইবারিক' (১৮৭২)-এ ধনী পরিবারের ঘরজামাই পোষার প্রথাকে হাসিঠাটার মধ্য দিয়ে ব্যা করা হয়েছে।
দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটককে কেন দলিল বলা যায় ?
সিপাহি বিদ্রোহের পর নীলকর সাহেবরা গ্রাম্য চাষিদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালাত। ধানের জমিতে জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করে ইংরেজ ব্যবসায়ীবৃন্দ চাষিদের সারাবছরের ক্ষুধার অন্ন উৎপাদন বন্ধ করত। নীলচাষে অনিচ্ছুক চাষিদের জোর করে আটক রাখা, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রহার—এমনকি মহিলাদের প্রতি অত্যাচার করতেও তারা দ্বিধাবোধ করত না। কিন্তু পরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা সংঘবন্ধ হয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং কলকাতার শিক্ষিত সমাজ এই আন্দোলনে সামিল হয়।
COMMENTS